মুঠো ভরা ভালোবাসা ! শামীম ফাতেমা মুন্নী
খাতা চেক করার ফাঁকে আড়চোখে খেয়াল করলাম, সামনের সারির কয়েকজন ছাত্রী আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে আর ফিসফিস করছে……..
শিক্ষকতা আমার শখ,আমার ভালোলাগা ! আইডিয়্যাল গ্রামার স্কুলেই আছি অনেক বছর ধরে। শিশু- কিশোরদের উচ্ছ্বলতায়,প্রচন্ড ভালোলাগা থেকেই এ পেশায় জড়িয়ে আছি। সহকর্মীদের মাঝে খুঁজে পাই আত্মার আত্মীয়দের, এখানেই পাই নিজের সত্ত্বার পরিচিতি! প্রাইমারী -হাই সেকশনের সব ছাত্র- ছাত্রীর ভালোবাসায় জড়িয়ে আছি আমি এখানে।
১ম শ্রেণীতে ক্লাস নিচ্ছিলাম,ইংরেজী পড়াই আমি ওদের।এই পাখিদের কিচিরমিচির ভালোই লাগে আমার। বোর্ডে কাজ দিয়ে কিছু নোটস নিলাম, এরপর খাতা চেক করার ফাঁকে আড়চোখে খেয়াল করলাম, সামনের সারির কয়েকজন ছাত্রী আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে আর ফিসফিস করছে।
হাতের কাজ শেষ করে ওদের দিকে ফিরে বললাম, আমাকে ও বলা যায় কি, চাঁদমুখগুলোতে এতো হাসির বন্যা কেন!!?? আর তাতেই ওরা হেসে আরো কুটিকুটি। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে একজন বললো,ম্যাডাম, আপনি আমাদের কথা শুনবেন? শুনলে কিন্তু আর না বলতে পারবেননা।
ঠিক আছে, না বলবোনা, শুনবো,এবার তো বলোআমায় –বললাম আমি। কিছুক্ষণ চুপচাপ–
এরপর একজন এগিয়ে এসে আমার হাতে তুলে দিলো আস্ত এক পিস কেক, আরেকজন এসে আমার আরেক হাতের মুঠো জোর করে খুলে মুঠো ভরিয়ে দিলো চিপস্এ,আরো একজন তারওপর ছড়িয়ে দিলো কিছু চকলেট!
আমি হতভম্ব হয়ে তাকাতেই ওরা সমস্বরে বলে উঠলো, এগুলো সব আপনার জন্য, আপনি খাবেন আর আমরা দেখবো, আমাদের বান্ধবীর জন্মদিন আজ! আমি একটু হেসে বললাম, আমার তো খিদে নেই, তোমরা খাও, আমি দেখি!
নাছোড়বান্দা দুষ্টুর দল আমার চারপাশে ঘিরে ধরে কেক এর টুকরো মুখে পুরে দিলো আমার,নিরুপায় আমি ও ওদের মুখে তুলে দিলাম তার ভাগ। ওদেরই একজন হয়ে গেলাম নিমেষেই, টিফিনগুলো শেয়ার করলাম আনন্দ-হাসি ভাগ করে,দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া আনন্দাশ্রু চশমার ফাঁকে মুছে ফেললাম ওদের অজান্তেই!
শৈশব পার হয়েছি সেই কত আগে,এই নিস্পাপ কচি-কাঁচারা আমাকে আমার সেই সোনালী শৈশব যেন কিছু মুহূর্তের জন্য ফিরিয়ে দিলো, তাদের সরলতায়, তাদের স্বার্থহীন ভালোবাসায়!
জীবন এমন সুযোগ বারবার সবাইকে দেয় না, আমাকে দিয়েছেন বিধাতা — আমার শিক্ষকতা জীবন এখানেই সার্থক,এ আমার পরম পাওয়া , ছাত্র-ছাত্রীদের পবিত্র ভালোবাসা।
ফুলবাগিচার কলকাকলীতে কুড়োনো সেই অনির্বাণ আনন্দ ভীষণ যত্নে ধারণ করলাম হৃদয়ে।
পৃথিবীর পথে চলতে চলতে অনেক আপনজনের ভালোবাসা বঞ্চিত এজীবনে হাজারো ব্যস্ততার ভীড়ে এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দটুকুই,আমার বেঁচে থাকার নির্যাস,আমারএকান্ত সঞ্চয়!
এভাবেই মুগ্ধতায় মন প্রাণ ভরে পৃথিবীর হাটে জীবনের পথে এগিয়ে চলি, সরলতার চাদরে নিজেকে বেঁধে এমন অপরুপ ভালোবাসায় আমি আকাশের নীলে হারাই, বিহঙ্গ হয়ে ডানা মেলি ভাবনার পবিত্র উন্মুক্ত আকাশে, মায়ার হাতছানিতে সাগরের বিশালতায় ডুবে যাই, সবুজ ঘাসের গালিচায় পা ভিজিয়ে হেঁটে বেড়াই, মায়াবী সম্পর্কের উদারতায় বাঁধি নিজেকে,উদাসী বাতাসের সোহাগে ফিরে পাই স্নিগ্ধ, বিমুগ্ধ এক আমার আমি কে !
বাস্তবতা নামের নকশিকাঁথার প্রতি ফোঁড়ে ফোঁড়ে বুনে চলি ভালোবাসার ছবি, ভালোলাগার সেই আমাকে নিয়ে ভীষণ মায়ায়।।
১০/০৪/২০২২
পরিচিতি :
শামীম ফাতেমা মুন্নী, প্রকৃতি, প্রেম, সম্পর্ক, মন, অনুভূতিগুলো বিমূর্ত হয়ে ওঠে যাঁর কবিতায়। দেশপ্রেম, সমাজ,চারপাশের অসংগতি, মানবতা , যাঁর মনের ক্যানভাসে, কলমের খোঁচায় তা যেন প্রাণ পায়।
চট্টগ্রামের ঐশী কবি খ্যাত বেগম ফজিলাতুল কদর তাঁর নানু। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি, বিভিন্ন পত্র- পত্রিকায় প্রকাশিত হয় মুন্নীর ছড়া-কবিতা- প্রবন্ধ। একসময় জীবনের ব্যস্ততায় লেখালেখি থেকে দূরে সরলেও কবিতার ছন্দে ফিরে এসেছেন একান্ত ভালোলাগা থেকেই।
প্রকাশিত বই এর সংখ্যা দুটো। শিশুতোষ বই–“হেমন্তের শেষ রাতে”, বড়দের কবিতার বই – “মন- জোছনায় ভালোবাসায়। ” চিকিৎসক স্বামী এবং দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তান নিয়ে সুখের সংসার শিক্ষিকা শামীম ফাতেমা মুন্নীর। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন। রোটারী ক্লাব অব মেট্রোপলিটন চিটাগং এর একজন রোটারিয়ানও তিনি।
11.04..2022