মর্জিনা আখতার
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের স্বাধিকার ও মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে জীবনের অনেকগুলো বছর কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকার কুঠুরিতে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবাই বিষয়টি বুঝলেও ছোট্ট রাসেল কারাগারকেই মনে করতো ‘‘আব্বার বাড়ি’’। বঙ্গবন্ধুর ‘‘কারাগারের রোজনামচা’’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘‘১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না, যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতো আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকছিল, তাই আমি জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরে ভেতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল, আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘‘আব্বার বাড়ি’’। এখন ওর ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি।’’ (দিনটি ছিল ১৯৬৬ সালের ১৫ জুন)।
বঙ্গবন্ধু রচিত ‘অসমাপ্ত আÍজীবনী’র বর্ণনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু প্রথম কারাগারে গিয়েছিলেন ১৯৩৮ সালে। তখন তিনি স্কুল ‘ছাত্র’ ছিলেন তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গোপালগঞ্জ আগমন উপলক্ষে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করার দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর উপর। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে তিনি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস থেকে নিষেধ করার পর হিন্দু ছাত্ররা সরে গিয়েছিল। কেননা শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগের সাথে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। সমাবেশ হয়ে যাওয়ার কিছুদিন পর হিন্দু মুসলমানের মধ্যে মারামারি হয়। এই ঘটনায় হিন্দুরা মামলা করে। সেই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বঙ্গবন্ধুকে সাতদিন কারাগারে থাকতে হয়।
জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাব সম্পর্কিত আলোচনা করেন প্রখ্যাত রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ ২০১৭ সালের ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে ৭ দিন বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বানকালে জীবনে দ্বিতীয়বার ও পাকিস্তান আমলে প্রথমবারের মতো ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ গ্রেপ্তার হন এবং পাঁচদিন কারাবরণ করে মুক্তি পান ১৫ মার্চ। এরপর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সমগ্র দেশ সফর শুরু করেন। এই সফর চলাকালীন সময়ে ওই বছরে ফরিদপুরে আবার গ্রেপ্তার হন ১১ সেপ্টেম্বর। ১৩২ দিন কারাভোগের পর মুক্তি পান পরের বছর ২১ জানুয়ারি।
১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে ধর্মঘটের ডাক দেয়। বঙ্গবন্ধু তাদের এই দাবির প্রতি সমর্থন জানান এবং তাদের পক্ষে আন্দোলনে অংশ নেন। এই কারণে ১৯ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং মুক্তি পান জুলাই মাসে। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল করে। কিছুদিন পর আবার তাঁর ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেন।
ওই বছর আর্মানিটোলা ময়দানে আয়োজিত জনসভা থেকে দরিদ্র মানুষের খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিল বের করা হয় ১৪ অক্টোবর। মিছিল থেকে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এবার বঙ্গবন্ধুকে দুই বছর পাঁচ মাস কারাগারে থাকতে হয়।
১৯৫২ সালে ২১ ফেব্র“য়ারি রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদ মিছিলে গুলি চলে। এতে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেকে। জেল থেকে বঙ্গবন্ধু এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে অনশনে যন। টানা অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়লে স্বাস্থ্যগত কারণে ২৬ ফেব্র“য়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়া হয়।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর ৩০ মে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসাবে বঙ্গবন্ধু করাচি থেকে ঢাকায় ফেরার পর গ্রেপ্তার হন। ২০৬ দিন কারাভোগ করে ২৩ ডিসেম্বর মুক্তি লাভ করেন। জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর উপর আক্রমণ এবং তাঁর মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা এবং সেনাবাহিনী প্রধান আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক আইন জারি করেন এবং সকল ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এরপর ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রায় ১৪ মাস বন্দী থাকার পর মুক্তি পেলেও জেল গেটেই আবার তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬০ সালের ৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করে তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি আবারও গ্রেপ্তার হয়ে মুক্তি পান ওই বছরের ১৮ জুন। এই দফায় তিনি কারাভোগ করেন ১৫৮ দিন। ১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আপত্তিকর বক্তব্য প্রদানের অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে তিনি ৬৬৫ দিন কারাগার ছিলেন।
১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেওয়ার পর ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন শহরে আটবার গ্রেপ্তার হন এবং ছাড়া পান। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জে সভা শেষ করে ঢাকা ফেরার পর ৮ মে আবার গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। ১৮ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও জেল গেট থেকে আবার গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু। সেইবার তাকে সেনানিবাসে রাখা হয়। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্র“য়ারি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবসহ সকল আসামিকে মুক্তি দেয়া হয়। এ সময় তিনি ১ হাজার ২১ দিন কারাগারে ছিলেন।
সর্বশেষ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস অনেক ত্যাগ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। শেষ দফায় বঙ্গবন্ধুকে থাকতে হয় ২৮৮ দিন।
‘‘বঙ্গবন্ধুর জেল জীবনের অজানা কাহিনী’’ শিরোনামে বিশ্লেষক ও গবেষক আবদুল মান্নানের লেখা এই প্রবন্ধটি ২০১৭ সালের ২০ মার্চ দৈনিক কালের কণ্ঠ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটির তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু ১৮ বার জেলে গেছেন। এ সময় দুইবার তিনি মৃত্যুর মুখোমুখিও হয়েছেন।
৫৫ বছরের জীবনে বঙ্গবন্ধু ১৪টি বছরই কারাগারে ছিলেন। তবে জেলজীবনকে ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত সৃষ্টিশীলভাবে। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে বন্দী ছিলেন, সে সময় বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তাঁকে তাঁর জীবনের কাহিনী লিখতে অনুরোধ করেছিলেন, প্রথমে তিনি এ প্রস্তাব নাকচ করে দেন। এই ভেবে তিনি লিখতে পারেন না, লিখে কি হবে এই ভেবে। পরে স্ত্রীর পুনরায় অনুরোধে তিনি কারাগারে বসে আÍকাহিনী লেখা শুরু করেন। চারটি খাতায় তা লেখা হয়েছিল। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, বঙ্গবন্ধুর লেখাগুলো বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের প্রেরণা ও অনুরোধের ফসল। বঙ্গবন্ধুর প্রথম বই ‘অসমাপ্ত আÍজীবনী’ প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। দ্বিতীয় বই ‘কারাগারের রোজনামচা’ প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে। তৃতীয় বই ‘আমার দেখা নয়াচীন’ ২০২০ সালে। কিন্তু ২০১২ সালে ‘অসমাপ্ত আÍজীবনী’ প্রকাশের পরপরই বঙ্গবন্ধুর লেখক সত্বার পরিচয় পাওয়া যায়, দীর্ঘ বন্দি জীবনে (৪৬৮২ দিন) তিনি রচনা করেছেন আমাদের ইতিহাসের দুটি আকরগ্রন্থ। অসমাপ্ত আÍজীবনী ও কারাগারে রোজনামচা। বঙ্গবন্ধুর রচিত তিনটি বইয়ের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বিশেষ সাহিত্য পুরস্কার’ দিয়েছে ফাউন্ডেশন অব সার্ক বাইটার্স এন্ড লিটারেচার এফ ও এমডব্লিউএএম। গ্রন্থ তিনটি আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের অনন্য দলিল।
এক বুক কষ্ট আর গভীর বেদনা নিয়ে এদেশে প্রতি বছর একটা দিনের সূর্য উদয় হয়। তা হলো ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। বাঙালির অশ্র“সিক্ত হওয়ার দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। বাঙালির মুক্তির দূত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ক্ষমতালোভী নরপিশাচ কুচক্রীমহল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে মুছে যায়নি। তিনি মৃত্যুঞ্জয়, তিনি অমর। তাঁকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার শক্তি কারোরই নেই।