নিউজ ব্যাংক বাংলা :
অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্য একটিই উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা এক পরিবার। আমাদের এক লক্ষ্য। কোনো ভেদাভেদ যেন আমাদের স্বপ্নকে ব্যাহত করতে না পারে, সেজন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ’।
‘গণরোষের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রধান দেশত্যাগ করার পর আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত।’
শুধু জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) একটি দেশের উন্নয়নের মাপকাঠি হতে পারে না। নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়, বন, মাটি আর বাতাস ধ্বংস আর দূষিত করে যে উন্নয়ন হয়, তা দীর্ঘমেয়াদি টেকসই নয়…..
অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর গতকাল রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণ দেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহতদের স্মরণ এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে ভাষণ শুরু করেন তিনি ।
এখনই সব দাবি পূরণ করার জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তিবিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, বিচারের জন্য গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আদালতে হামলা করে আগেই এক ধরনের বিচার করে ফেলার যে প্রবণতা, তা থেকে বের হতে হবে….
তিনি আরও বলেন, ‘কখন নির্বাচন হবে, সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন।’
নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমরা কেউ দেশ শাসনের মানুষ নই। নিজ নিজ পেশায় আমরা আনন্দ পাই। দেশের সংকটকালে ছাত্রদের আহ্বানে আমরা এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। আপামর জনসাধারণ আমাদের নিয়োগ সমর্থন করেছে। আমরা সমস্ত শক্তি দিয়ে এই দায়িত্ব পালন করব। তারা যখন বলবে, আমরা চলে যাব।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রতিদিন সচিবালয়ে, আমার অফিসের আশপাশে, শহরের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করা হচ্ছে। গত ১৬ বছরের অনেক দুঃখ-কষ্ট আপনাদের জমা আছে। সেটা আমরা বুঝি। আমাদের যদি কাজ করতে না দেন, তাহলে এই দুঃখ ঘোচানোর সব পথ বন্ধ হয়ে থাকবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ আমাদের কাজ করতে দিন। আপনাদের যা চাওয়া তা লিখিতভাবে আমাদের দিয়ে যান। আইনসংগতভাবে যা কিছু করার আছে আমরা অবশ্যই তা করব।’
প্রবাসীদের মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে দেশে আসা এবং যাওয়া নিশ্চিত করার কথা জানান প্রধান উপদেষ্টা। একই সঙ্গে প্রবাসীদের উপার্জিত অর্থ অফিশিয়াল চ্যানেলে দেশে পাঠানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে এই অর্থ বিশেষভাবে প্রয়োজন।
ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের হাতে দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, শিক্ষা খাতকে পঙ্গু করে দিয়েছে, ব্যাংক ও পুঁজিবাজার খাতে লুটপাট, প্রকল্প ব্যয়ে বিশ্বরেকর্ড, অবাধ সম্পদ পাচার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে নিজ দলের পুতুলে রূপান্তর, বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার হরণ করেছে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ফ্যাসিবাদী সরকার খর্ব করেছে জনগণের সাংবিধানিক ক্ষমতা ও অধিকার। দুঃশাসন, দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার নিপীড়ন, বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে জনসুরক্ষা বিপন্ন করেছে। জনগণকে নির্যাতন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের মানুষসহ কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকারকে বছরের পর বছর হরণ করেছে।
ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে নস্যাৎ করতে যে শত শত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা করা হয়েছিল, তার অধিকাংশ প্রত্যাহার করে আটক ছাত্র-জনতার মুক্তিলাভের ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেন ড. ইউনূস।
তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে মিথ্যা ও গায়েবি সব মামলা প্রত্যাহার করা হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পুনর্বাসন করা হবে গণ-অভ্যুত্থানে সব শহীদের পরিবারকে। আহতদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় সরকার বহন করবে।
জুলাই-আগস্ট মাসে গণ-অভ্যুত্থানে বলপ্রয়োগ ও হতাহতের যে দুঃসহ ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তার স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করতে সরকারের আমন্ত্রণে জাতিসংঘের তদন্ত প্রক্রিয়া এ সপ্তাহেই শুরু হবে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা।
ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং আয়নাঘরের মতো চরম ঘৃণ্য সব অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত সবার বিচার নিশ্চিত করা হবে। তালিকা প্রস্তুত করে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে। দুর্নীতি ও সম্পদ পাচারের বিচার করার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে জনমুখী ও দলীয় প্রভাবমুক্ত এবং জবাবদিহিমূলক কাঠামো সৃষ্টির লক্ষ্যে পুলিশ কমিশন গঠনের কথা জানান ড. ইউনূস। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে আর কোনো দিন কেউ যেন কোনো পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত না করতে পারে, তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, এখনই সব দাবি পূরণ করার জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তিবিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, বিচারের জন্য গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আদালতে হামলা করে আগেই এক ধরনের বিচার করে ফেলার যে প্রবণতা, তা থেকে বের হতে হবে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের গৌরব ও সম্ভাবনা এসব কাজে মøান হয়ে যাবে, বিপ্লবী ছাত্র-জনতার নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টাও এতে ব্যাহত হবে।
তিনি আরও বলেন, কৃষকের স্বার্থ সুরক্ষায় তারা যেন উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান, তা নিশ্চিত করা হবে। স্বাস্থ্য খাত অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত। জনগণের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সব মানুষের সমান স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, শুধু জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) একটি দেশের উন্নয়নের মাপকাঠি হতে পারে না। নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়, বন, মাটি আর বাতাস ধ্বংস আর দূষিত করে যে উন্নয়ন হয়, তা দীর্ঘমেয়াদি টেকসই নয়। সরকার তরুণ সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করে পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে।
১৭ বছর আগের একটি ছবি। চট্টগ্রামের এক অনুষ্ঠানে নোবেলজয়ী চট্টগ্রামের সন্তান ড. মুহাম্মদ ইউনুস – ছবি : রিয়াজ হায়দার চৌধুরী
গত ১৫ বছরের দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি স্বাক্ষর, প্রকল্পের নামে লুটপাট ইত্যাদি তথ্য নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়নের জন্য ইতিমধ্যে কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতা স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, সেই স্বপ্ন পূরণে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।’
এতদিন দেশে যেভাবে দুর্নীতি হয়েছে, তা বোঝাতে স্বৈরাচারের (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) পিয়নও দুর্নীতির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার মালিক হওয়ার তথ্য তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ।
ড. ইউনূস বলেন, ‘মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে স্বৈরাচার তার নিজের, পরিবারের ও দলের কিছু মানুষের স্বার্থ হাসিলের পথ তৈরি করে দিয়েছে। যেকোনো সময় আদর্শ নির্বাচনের জন্য আমরা নির্বাচন কমিশনকেও সংস্কার করব।’
ঘুষ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘লাখ লাখ শহীদের রক্ত ও মা-বোনের আত্মদানের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ আমরা পেয়েছিলাম, তা ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের হাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে দুর্নীতি।
আর্থিক খাত ও পুঁজিবাজারে লুটপাটের কথা উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, লুটপাট ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি জীবনযাপন সহজ করতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক খাতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য ব্যাংক কমিশন গঠন করা হবে। পুঁজিবাজার, পরিবহন খাতসহ যেসব ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে, তা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বন্যাদুর্গতদের জীবন দ্রুত স্বাভাবিক করার জন্য যাবতীয় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বন্যা-পরবর্তী কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে সব ধরনের বন্যা প্রতিরোধে আমাদের অভ্যন্তরীণ এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে যাতে যৌথভাবে নেওয়া যায়, সে আলোচনা শুরু করেছি।’
বিচার বিভাগকে দুর্নীতি ও দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই, যেন এ দেশে জনগণই সত্যিকার অর্থে সব ক্ষমতার উৎস হয়। বিশ্ব দরবারে একটি মানবিক ও কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে সমাদৃত হয়। তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষার্থী ও জনতার আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে সফল আমাদের হতেই হবে। এর আর কোনো বিকল্প নেই।’
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। আমাদের সব উপদেষ্টা দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করবেন। পর্যায়ক্রমে এটি সব সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও নিয়মিত এবং বাধ্যতামূলক করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘তথ্যের অবাধপ্রবাহ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করে এমন সব আইনের নিপীড়নমূলক ধারা চিহ্নিত করে সেগুলো সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমকর্মীরা নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা চালিয়ে যাবেন।’
বিগত সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠিত করে গেছে উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলেন, ‘আমরা তার পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের উদ্যোগ নেব। এটা আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার। পাঠ্যক্রমকেও যুগোপযোগী করার কাজও দ্রুত শুরু করা হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলেন, ‘বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করার মাত্র দুই সপ্তাহ শেষ হলো। কর্মযাত্রার প্রথমপর্যায়ে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে আপনাদের কাছ থেকে যে সমর্থন পাচ্ছি, সেজন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। আমরা অনুধাবন করছি, আমাদের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা অনেক। এ প্রত্যাশা পূরণে আমরা বদ্ধপরিকর। যদিও দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের জন্য পর্বতসম চ্যালেঞ্জ রেখে গেছে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আমরা প্রস্তুত। আজ আমি সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করতে আপনাদের সামনে এসেছি। শুধু আমি বলব, আপনাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে। নতুন বাংলাদেশ গড়তে সবাই এগিয়ে আসুন।’
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন ড. ইউনূস।
26/08/2024