প্রিয় আব্বা …

Must Read

প্রিয় আব্বা : সৈয়দা আমেনা ফারহিন

প্রিয় আব্বা,
তোমার লেখা চিঠিটা পড়ছিলাম। আমাকে লেখা তোমার প্রথম ও শেষ চিঠি। তোমার কত চিঠির আমি ডিকটেশন নিতাম। অথচ, তোমাকে কখনো চিঠি লেখা হয়নি। হয়ত, তাতে মনের সব কথা জানাতে পারতাম। তুমি তো জানোই, আমি ছোটকালে তোমার ভয়ে ঠিকমত কথা বলতে পারতাম না। পরে অবশ্য তোমার সাথে অনেক আড্ডা দিতাম। রাত দু’টা তিনটা পর্যন্ত অড্ডা দিতাম। আম্মা বকা দিয়ে ঘুমাতে পাঠাতো। পৃথিবীটা তখন খুব সুন্দর ছিল। আস্তে আস্তে পৃথিবী যান্ত্রিক হতে থাকে। আমি যান্ত্রিকতায় আত্নস্ত হতে পারিনি। খুব ইমোশনাল আমি। আমার কথারা অভিমানে হারিয়ে যেতে লাগল। একসময় খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতাম না। পড়াশোণা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কত ছেলে মেয়েরা কত কিছু করে। আমার শুধু পড়াশোণা আর বাসায় ফেরা। এরমধ্যেও কত দোষ ধরল মানুষ! তুমি আমায় এতই কড়া শাসনে মানুষ করেছো, তোমার দেয়া ছকের বাইরে যাবার সাহস হয়নি কোনদিন!! মানুষগুলোর কথাগুলো আরো তীক্ষ্ণ ছুড়ির মত হতে লাগল। আমি অবাক হতাম। তুমি বলতে, “ধৈর্য্য ধর। মানুষ যখন চারপাশ থেকে তোকে ঘিরে ধরবে। আল্লাহ তোকে উপরে তুলে নেবে।” চোখে পানি নিয়ে কিছু মানুষের কর্ম দেখতাম। এখন মনে হয়, এগুলো ছিল তাদের পাপ। আমাকে তুমি অনেকটা অসূর্যস্পর্শা করে গড়ে তুলেছিলে। ভীষণ চুপচাপ একটা মানুষ তৈরী করেছিলে। তোমার কথামত সব সহ্য করতাম। আমায় দেখে তোমার চোখে পানি আসত। তুমি শিখিয়েছিলে, কিভাবে মানুষের সামনে ভদ্র থাকতে হয়, আর কিভাবে অপাত্রে দান না করতে। শেষেরটা কেন জানি বেখাপ্পা লাগত। এখন বুঝি, সেটাই ছিল তোমার দৃঢ়তা।

তোমার নিজ হাতে লেখা জীবনী পড়ছিলাম। আমাকে যেভাবে গড়েছো, তার সম্পূর্ণ উল্টো ছিলে তুমি।

লেখাটির বাকি অংশ দেখুন নীচের লিংক/ছবি/ভিডিও এর পর-

জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি, আওয়ামীলীগ ও নির্বাচন নিয়ে আলোচিত টকশো :
মেজর জেনারেল অব ইব্রাহিম যা বললেন,
জানতে হলে লিংক চাপুন –

ছাত্ররাজনীতিতে কি ভীষণভাবে জড়িত ছিলে তুমি!! ১৯৬৬ র ছয়দফা আন্দোলন এ তুমি সরাসরি জড়িত। তোমার শ্রদ্ধেয় জমির দাদা, তখনকার ছাত্রলীগের সভাপতি, মৃত্যুর আগে তার ওসিয়তনামায় তোমার নাম লিখে যান। কি দারুণ সহমর্মিতা ছিল তোমাদের তখনকার রাজনীতিবীদদের! তখন তুমি এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিপক্ষকে হোস্টেলগুলোর মেইন ইলেকট্রিসিটির লাইন অফ করে তোমার কথায় কাউকে পিটুনি দেয়া হয়েছে। তোমাদের রাজনীতিতে ভায়োলেন্স মানে ততটুকুই।

একবার রেগে গিয়ে তুমি ও তোমার কয়েকজন সহযোগি ‘বাংলা ছাত্রলীগ’ করবে জানালে তোমার শ্রদ্ধেয় আজিজ ভাইকে। তাঁর ধমকে কাজ হল। তুমি জেলা পর্যায়ে রাজনীতি করলে আর তোমার বন্ধু এ.বি.এম মহিউদ্দিন চলে গেলেন মহানগরে।

অথচ, আমাদের কখনো এ বিষয় নিয়ে তুমি কখনো কিছু বলতে না। একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছো, এটাই তোমার বড় প্রাপ্তি। মানুষ যখন বলত, তোমার সামনে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে, আরেকটুর জন্য বেঁচে গিয়েছো তুমি, ভীষণ কেয়ারলেস লাগত তোমাকে! রাগ হতো জানো? মনে হত, তোমার কিছু হলে?

মহান মুক্তিযুদ্ধের আগ থেকেই তুমি সরকারী ইঞ্জিনিয়ার। তোমার কাফলিংক দামী দামী রত্নখচিত থাকত। কি শৌখিন ছিলে তুমি। অথচ, মহান মুক্তিযুদ্ধের পর আরেক যুদ্ধে নেমে গেলে তুমি। দাদা মারা গেছেন। ছোট ভাই-বোনদের কষ্ট বুঝতে দাওনি। এগারটা বছর পরিশ্রম করে তাদের বড় করে তুললে। তাদের জন্য দেরিতে বিয়ে করলে। তোমার বড় ভাইয়ের কথায় ওয়াসার চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতায় চলে আসলে। তোমার জীবনে তোমার ছোট ভাই-বোনদের গুরুত্ব ছিল অনেক। কেউ কষ্টে আছে, চুপিচুপি গিয়ে যা দরকার সেটা করে দিয়ে এসেছো। তোমার ছোট বোনের অপারেশন, তোমার বেতনের চেয়ে বেশি টাকা লাগবে, বেতন পেয়ে পুরোটাই দিয়ে এসেছো। সারা মাস ধার করে চললে। ওরসের পর তোমার যে বোনটা সবচেয়ে কষ্টে আছে, সবার আগে তার বাসায় যেন গোস্ত চলে যায় সেটা তদারকি করেছো। কাউকে কাউকে দেখেছি এ নিয়ে টিটকারী করতে। তুমি সহ্য করে যেতে। কারো চাকরিতে সমস্যা হয়েছে, তুমি তোমার বন্ধু মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছে চলে গিয়েছো।
একজন বলেছিলেন, এটা তোমার বাবার দায়িত্ব, বাবার হয়ে তুমি পালন করেছো, তুমি আলাদা কিছু করোনি। তুমি শুধু হাসতে। একদিকে তুমি যেমন ভীষণ রাগী, অন্যদিকে মায়ার শরীর।

তোমার অফিসের কলিগ, তোমার স্টাফ সবার প্রতি তোমার মায়া। যেমন শাসন করতে, তেমন তাদের বিপদে সবার আগে তোমাকেই দেখা যেত। কাপ্তাই থাকতে একবার আম্মা পাঁচহাজার টাকা দিয়ে একটা কাঠের আলমারী তৈরী করালেন। তোমার পিয়ন সেটা চাইতেই তুমি দিয়ে দিলে। আম্মা যে কি কষ্টটাই পেয়েছিল। সারাজীবন এটা নিয়ে তোমাকে কথা শুণাইছে। আর তুমি হাসতে। তোমার ছাত্ররা ক্রসফায়ারে পড়লে তুমি দৌড়ে স্পটে চলে যেতে। আমাদের হৃদপিন্ড চড়ুই পাখির মত ধরফর করত। দাদু বাসায় আসলেও তোমাকে আটকে রাখতে পারতেন না। ছাদে যাচ্ছি বলে দৌড়ে চলে যেতে। অফিসের মাইক্রো নিয়ে ছাত্রদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে। ছাত্রটা কোন রাজনৈতিক দল করে সেটা তুমি ভাবতে না। ছাত্ররা বন্দুক উচিঁয়ে মিছিল করছে। কেউ গুলিবদ্ধ। এর মধ্যেই তোমার হুংকার। গুলিবদ্ধ ছাত্র নিয়ে তুমি হাসপাতালে। মিছিলটা তোমার সামনে মিয়ে গেছে। কারণ তারা জানত তুমি কোন লেভেলের গান্ডু। যে ছেলেটি তোমাকে গুলি করে দেবে বলে হুমকি দিয়ে গেছে, তাঁর মৃত্যুতে তুমি অঝোরধারায় কেঁদেছো। আর যে ছেলেগুলো তোমার কারণে বেঁচে ফিরেছে, তাঁরা পথে ঘাটে যেখানে তোমাকে পেত, ছুটে আসত সালাম করতে। তুমি এমন কেন ছিলে? একটা পাগল, একটা খেপাটে, আবার মায়ার শরীর। এখনো আমাদের কোন কাজে লাগলে, তাঁরা আমাদের চিনতে পান তোমার সন্তান হিসেবে।

আমাদের জীবনে কখনো যান্ত্রিকতা এসে ভর করে। একটা সময় পর থেকে আমার চোখে খুব একটা অশ্রু আসে না। আমার এ যুদ্ধটা আমি একা করেছি। তুমি হয়তো চাইলেও পারতে না। আমার জন্য তুমি দোয়া করতে। আমার রাগ দেখানোর দুইটা জায়গা ছিল। এক তুমি, আরেকটা আম্মা। আম্মাও চলে গেল, তারপর তুমি বড্ড একা। আমি চেয়েছিলাম তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে। মৃত্যুর দেড়মাস আগে এলে আমাকে দেখতে। আমি তখন বেশ অসুস্হ। দাইফেরও খুব জ্বর। বাপ বেটি মিলে সারাক্ষণ গল্প করি। আমার খুব প্রয়োজন ছিল তোমাকে। তুমি কেমনে বুঝলে, চলে এলে। তোমার প্রতি সব অভিমান, রাগ পানি হয়ে গেল। তুমি বলতে, তুই খুব বোকা, তোর সব কিছু বুঝে নে। আমি বলতাম, আমার তুমি থাকলেই হবে আব্বু।

তোমার জয়গাটা এখন একটা শূণ্যস্হান। তবে এখন তুমি আমার স্মৃতিতে, আমার রক্তে প্রবাহমান। তোমার প্রতি অনুভূতিটা আরো তীব্রতর, আমার রাগী আব্বা।

পরিচিতি –
সৈয়দা আমিনা ফারহিন। লক্ষ্মীপুরে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ।
২০০৮ সালের ২২ মে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসে যোগদান করেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর আইন অনুষদ থেকে ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার মাইজভান্ডার দরবার শরীফ।

তিনি মাইজভান্ডার দরবার শরীফের আওলাদ এবং মাইজভান্ডার দরবার শরীফের আওলাদদের মধ্যে দ্বিতীয়তম বিচারক। বেড়ে ওঠেছেন চট্টগ্রাম জেলার প্রাণবন্ত সবুজ পরিবেশে। ছোটবেলা হতে কবিতা লেখার অভ্যেস। অবসরে বাগান করেন, বই পড়েন, মুভী দেখেন।

- Advertisement -spot_img

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img
Latest News

তারেক রহমানকে দেশে ফেরার সুযোগ দিতে হবে : মির্জা ফখরুল

নিউজ ব্যাংক বাংলা: বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, কোনো রকম টালবাহানা সহ্য করা হবে না। সমস্ত মামলা প্রত্যাহার...
- Advertisement -spot_img

More Articles Like This

- Advertisement -spot_img