লেখক: শাহ মিডু , নিউজ ব্যাংক বাংলা:
ইয়াওমুল মওলায়্যাত বা গাদীরে খোমে আখেরী নবী মোহাম্মদ (দ.) কর্তৃক নিজ স্থলাভিষিক্ত করে মওলা আলী (আ.)’র মওলায়্যাত ঘোষিত হয়। সে ঘোষণার আলোকে আলী (আ.)’র প্রতি বশ্যতাস্বীকার করা বা না করার মধ্য দিয়ে মুসলিম জাহান সুস্পষ্টভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক দিকের নেতৃত্বে ছিলেন নবী (দ.) ঘোষিত খলিফা মওলা আলী (আ.) আর অন্য দিকে দাঁড়িয়ে যায় বিদ্রোহী প্রাদেশিক প্রশাসক, নবী (দ.)’র পরিবার বিদ্বেষী মুয়াবিয়া।
অথচ রহমাতুল্লিল আলামিন নবী মোহাম্মদ (দ.) সেদিন ঘোষণা করেছিলেন, “আমি যার মওলা, আলীও তার মওলা” (অভিভাবক)। তিনি (দ.) মওলা আলী (আ.)’র প্রতি এনায়াতকৃত জ্ঞানের মহিমা প্রকাশ করতে গিয়ে ইরশাদ করেন, ”আমি জ্ঞানের জগত। আলী সেই জগতের প্রবেশদ্বার”।
অথচ নেহায়াত নবী (স.) বিদ্বেষী- প্রতিশোধ পারায়ন হওয়ায়, কুচক্রি মুয়াবিয়া সুযোগ পাওয়া মাত্রই মওলা আলী (আ.)’র বিরুদ্ধে সাপের মত শত্রুতার ফনা তুলে দাঁড়িয়ে যায়। সে ধারবাহিকতায় কারবালা হয়ে যায় অনিবার্য। সে ভাবেই নানা মত ও দলে বিভক্তি আজও চলমান। একদল অন্যদলের বিরুদ্ধে বিদাত ফতোয়া দেয়া আজ নিত্যনৈমিত্যিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ বলে শত বৎসর পূর্ব হতে উদযাপিত হয়ে আসা ঈদে মিলাদুন্নবী বিদা’ত। তাদের চোখে অতি সাম্প্রতিক কালে প্রবর্তিত ইয়াওমুন নবী বা প্রপেট্স ডে তথা মহান নবী দিবসের তো কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকার কথাই নয়।
না। আমি ঐ সব দল- উপদলকে উদ্দেশ্য করে লিখছিনা। তাদের প্রতি ইতিহাস প্রসিদ্ধ জ্ঞানগর্ভ বহু কিছু লেখা হয়েছে। ধর্মতাত্ত্বিক বিজ্ঞ মহারথিগণের লেখা থেকেও এত বছরে যেহেতু তারা হেদায়েত প্রাপ্ত হননি। তখন আমি নেহায়াত নগন্য, ওদিকটায় সময় দেয়াকে নিজের সময় নষ্ট করা মনে করি। ওসব শরিয়তি আলেম শ্রেনীর কাজ। তাদের জন্য আলাদা করে রেখে যেতেই হবে। তারা করবেন। তারা করছেন। তাদের জানাই সাধুবাদ।
আগামী ২৯ আগস্ট উদযাপিত হতে যাচ্ছে মহান নবী দিবস। ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) ও ইয়াওমুন নবী (দ.) কোন ভিন্ন প্রকৃতির আয়োজন নয়। এ দু’টি যেন একই মূদ্রার এপিট, ওপিট। যা ইক্ষু তা-ই আখ। আঞ্চলিক ভাষায় তাকে কুইশশেল বা গেন্ডারী বললেও, বুঝায় সেই একই বস্তু। ধাঁধায় আছে, আল্লাহর কি কেরামত, লাঠির ভিতর শরবত।
যদি কোন বিবেচনায় ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) বিদা’ত- শরিয়ত বিবর্জিত হয়, ইয়াওমুন নবী (দ.)-ও অনুরুপ বিবেচনায় বিদা’ত- শরিয়ত বিবর্জিত।
ছাকীয়ে কাওছার, শাফায়ে মাহাশর মওলা নবী মোহাম্মদ (দ.)’র পৃথিবীতে আগমনের আনন্দ উদযাপনে সৌর বার্ষিক ক্যালেন্ডার মোতাবেক ২৯ আগস্ট ৫৭০ ইংরেজি স্মরণে পালিত হয় ইয়াওমুন্নবী যার বাংলা নাম, ”মহান নবী দিবস” (দ.)। অন্যদিকে সেই একই দিনের স্মরণে চান্দ্র বার্ষিক ক্যালেন্ডার মোতাবেক (মতভেদ থাকলেও) ১২ই রবিউল আউয়াল পালিত হয় ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.)।
কিন্তু সাযুজ্যতা তালাশে যুক্তি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, যদি কোন বিবেচনায় ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) আয়োজন- উদযাপন ধর্মতে বৈধতা পায়, ঠিক অনুরুপ বিবেচনায় ধর্মতাত্ত্বিক বৈধতা পাবে ইয়াওমুন নবী (দ.)। এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই।
এখানে আমি প্রচলিত চান্দ্র বার্ষিক ও সৌর বার্ষিক দিন গণনার যে রীতি বা ক্যালেন্ডার সমূহ জগতে প্রচলিত রয়েছে তার ভিত্তিতে উক্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠান দ্বয় উদযাপনের বৈধতা- অবৈধতার বিষয়টুকুতে আলোকপাত করার প্রয়াস পাচ্ছি।
পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে চাঁদ পৃথিবীকে যে অক্ষরেখায় আবর্তন করছে, সে অক্ষরেখায় চাঁদ একদিন বা ২৪ ঘণ্টায় ১৩°কোণ অতিক্রম করে। সুতরাং পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে চাঁদের সময় লাগে ২৭ দিন ৭ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট ১১ সেকেন্ড। আমরা পৃথিবী থেকে চাঁদের একই পৃষ্ঠ সবসময় দেখতে পাই। কারন চাঁদের আবর্তনের পর্যায়কাল এবং তার কক্ষপথের পর্যায়কাল একই। চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে ২৭ দিন ৭ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট ১১ সেকেন্ড সময় নেয়। ফলে বুঝা গেল, চাঁদ প্রদক্ষিণ করছে পৃথিবীকে।
সূর্য আমাদের মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রের চারপাশে প্রতি ঘন্টায় ৮ লক্ষ কিলোমিটার বা ৫ লক্ষ মাইল বেগে ঘুরছে। এত বেশি বেগে ঘুরেও পুরো ছায়াপথকে ঘুরে আসতে সূর্যের প্রায় ২৫ কোটি বছর সময় লাগে। তাহলে বুঝা গেল, সূর্যও প্রদক্ষিণ রত নিজ কক্ষপথে।
কিন্তু সৌর বর্ষ গণনা করা হয় সূর্যের সে ঘূর্ণনের ভিত্তিতে নয় বরং পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে তার চতুপাশ কতদিনে একবার ঘুরে আসে সে হিসাবের ভিত্তিতে।
সূর্যের মহাকর্ষ বলের আকর্ষণে পৃথিবী নিজের অক্ষের উপর অবিরাম ঘুরতে ঘুরতে একটি নির্দিষ্ট পথে নির্দিষ্ট দিকে (ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে) এবং নির্দিষ্ট সময়ে সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণের এই গতিকে বার্ষিক গতি বা পরিক্রমণ গতি বলে।
একবার সূর্যকে পূর্ণ পরিক্রমণ করতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড। একে সৌরবছর বলে। কিন্ত আমরা ৩৬৫ দিনকে এক বছর ধরি। এতে প্রতি বছর প্রায় ৬ ঘণ্টা অতিরিক্ত থেকে যায়। এ অতিরিক্ত সময়ের সামঞ্জস্য আনার জন্য প্রতি ৪ বছর পরপর ফেব্রুয়ারী মাসকে ১ দিন বাড়িয়ে ২৯ দিন করা হয় এবং ঐ বছরটিকে ৩৬৬ দিন ধরা হয়। সেই বছরকে লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ বলে। সাধারণত কোন বছরকে ৪ দিয়ে ভাগ করলে যদি ভাগশেষ না থাকে তবে ঐসব বছরকে অধিবর্ষ বা লিপ ইয়ার ধরা হয়।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যদিও উভয় ঘুর্ণনের হিসাব মতে বর্ষ গণণা করা যায়। কিন্তু ঋতু পরিবর্তনে উভয়ের প্রভাব কার্যকর নয়। জোয়ার ভাটা চাঁদের প্রভাবে হয়, যা দৈনিক ঘটনা। প্রতি তিন চন্দ্র বর্ষে মাসগুলি সৌর বর্ষের তুলনায় প্রায় ৩৩ দিন এগিয়ে যায়। ফলে এ বছর যে চন্দ্র মাসে গ্রীষ্মকাল, ৩/৪ বছর পরে সে চন্দ্র মাসে হবে বর্ষাকাল। কিন্তু ঋতু পরিবর্তন সৌর বর্ষের প্রভাবে হয় বলে একই মাসে প্রতি বছর একই ঋতুর আগমন ঘটে।
তাই সহজেই বলা যায়, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে উভয় রুপ বছর গণনার প্রভাব বিদ্যমান। কোনটাকেই অস্বীকার করার সুযোগ নাই। সে যাই হোক। এবার আসুন, ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী বিবিধ আচার- অনুষ্ঠানাধি উদযাপনের ক্ষেত্রে চন্দ্র ও সূর্যের প্রভাবসিদ্ধ দিন-ক্ষণ গণনা ও বর্ষপঞ্জিকা অনুসরনের গুরুত্ব নিয়ে একটু দৃষ্টিপাত করি।
স্রষ্টা মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন-
فَالِقُ الْإِصْبَاحِ وَجَعَلَ اللَّيْلَ سَكَنًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ حُسْبَانًا ۚ ذَٰلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ
অনুবাদ : তিনি প্রভাত রশ্মির উন্মেষক। তিনি রাত্রিকে আরামস্থল করেছেন এবং সূর্য ও চন্দ্রকে সৃষ্টি করেছেন গণনার জন্য। এটি পরাক্রান্ত মাহাজ্ঞানীর নির্ধারণ- (সূরা আন’আম, আয়াত ৯৬)।
এ থেকে যা প্রমাণীত-
(ক) চন্দ্র ও সূর্য উভয়টি সময় জানার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
(খ) আল্লাহর নিকট এই দুই প্রক্রিয়াই নির্ধারিত।
হাসিবুন (حسبان) শব্দ উল্লেখ করে কোরআনে বর্ণনা-
الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ بِحُسْبَانٍ
অনুবাদ : সূর্য ও চন্দ্র (আল্লাহর) গণনা মতে চলে – (আর রহমান, আয়াত ৫)।
কোরআনের তথ্যবহুল আরেকটি আয়াতে করিমায় আল্লআহ পাক এরশাদ করেন-
وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ آيَتَيْنِ ۖ فَمَحَوْنَا آيَةَ اللَّيْلِ وَجَعَلْنَا آيَةَ النَّهَارِ مُبْصِرَةً لِّتَبْتَغُوا فَضْلًا مِّن رَّبِّكُمْ وَلِتَعْلَمُوا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ ۚ وَكُلَّ شَيْءٍ فَصَّلْنَاهُ تَفْصِيلًا
অনুবাদ : আমি রাত্রি ও দিবস দুইটি নিদর্শন করেছি এবং নিস্প্রভ করে দিয়েছি রাতের নিদর্শন আর দিনের নিদর্শনকে করে দিয়েছি দেখার উপযোগী, যাতে তোমরা তোমাদের পালনকর্তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করো এবং যেন তোমার বছর সমূহের সংখ্যাতত্ত্ব ও গণনা জানতে পারো। আর আমি প্রত্যেক কিছু সবিস্তারে আলোচনা করেছি – (বনী ইসরাঈল, আয়াত ১২)।
এখানে যা প্রমাণীত:
(ক) এই আয়াতে কারিমাটিতে বছর সমূহ ও সময় নির্ধারণের জন্য সরাসরি সূর্যকে উল্লেখ করা হয়েছে।
(খ) হিসাব (সময়) ও সিনীন (বছর সমূহ) এ শব্দ দ্বয়, সমগুরুত্ব সহকারে সূর্য ও চাঁদ উভয়টির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে।
উপরোল্লেখিত ফরমানে ইলাহি দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, সূর্য ও চন্দ্র উভয়টি আল্লাহরই নিয়ন্ত্রণাধীন। উভয়টিই সময় নির্ধারণ ও সংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত জানার জন্য সৃষ্ট।
বিশ্বব্যাপি এ উভয় প্রক্রিয়াই সঠিক ও নির্ভুল। উভয়টির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক সময় বা তারিখ নির্ধারণ অকাট্য ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত।
তাই বলব, রহমাতুল্লিল আলামীন নবী (দ.)’র স্মরণে গণনার সৌর বা চন্দ্র বর্ষ দ্বয়ের যে কোনটির তারিখ ধরে অনুষ্ঠান আয়োজন করা যাবে। এতে ধর্মতাত্ত্বিক কোন জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার কারন নাই। কেননা, ইসলামে চন্দ্র ও সূর্য উভয়ের সংখ্যাতাত্ত্বিক গণনা সমভাবে গ্রহণযোগ্য।
লেখক পরিচিতি:
শাহ মিডু,
কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি সম্পাদক, বাংলাদেশ তরিকত পরিষদ (বিটিপি) ।
খলিফা, রাহে ভান্ডার সিলসিলা ও আওলাদ, চট্টগ্রাম দরবার শরিফ।
#ShahMedu
.
.
আমাদের ঘোষণা:
আমাদের প্রকাশিত নিবন্ধ/কলাম সমূহের মতাদর্শ, বক্তব্য, দৃষ্টিভঙ্গী এমনিক এতে ব্যবহুত তথ্য, তত্ত্ব ও সকল প্রকার সূত্র লেখক কর্তৃক লিখিত, নির্ধারিত এবং সংযোগকৃত। এর যাবতিয় দায়ভার একান্তই লেখকের । আমরা, নিউজ ব্যাংক বাংলা ডট কম কর্তৃপক্ষ এর কোন বক্তব্য বা দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য দায়ী নই ।