এস.এম.এস. আলম, নিউজ ব্যাংক বাংলা:
কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম শহরে বিশাল এলাকা নদীতে পরিণত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বহদ্দারহাট নদী, মুরাদপুর নদী, ষোলশহর নদী, বাইদ্দেরটেক নদী, চকবাজার নদী, কাতালগঞ্জ নদী, রাহাত্তারপুল নদী, হালিশহর নদী, আগ্রাবাদ নদী ইত্যাদি। এমতাবস্থায় সেই নদীগুলিকে বলা হচ্ছে ইউরোপের নদী। ইউরোপের সেসব নদীতে জাল মেরে অনেক মানুষ মাছ ধরছেন। এমন সব ট্রল এখন সোস্যাল মিডিয়াতে ঘুর-পাক খাচ্ছে।
বাংলা সিনেমার এক সময়কার জনপ্রিয় নায়ক রিয়াজ বিশাল এক কাতলা মাছ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক নদীর মাঝখানে। নায়ক রিয়াজকে নিয়ে এই মিমটি এখন ভাইরাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
চট্টগ্রামের বাইরে বসবাসকরি মানুষের মনে এ বিষয়টিতে খটকা লাগবে অবশ্যই। কিন্তু মুখে এখন নায়ক রিয়াজের নাম গত কয়েক দিনে ডুবে যাওয়া চট্টগ্রাম শহরের হাজার হাজার মানুষের মুখে মুখে। এ নিয়ে ফেসবুক পোস্ট, কমেন্ট, রিল, ভিডিও ইত্যাদির অন্ত নেই। যেমন ‘নায়ক রিয়াজের তেলে, চট্টগ্রাম ডুবল জলে’।
চট্টগ্রাম পানির নিচে তলিয়ে গেলেই এভাবে উচ্চারিত হয় নায়ক রিয়াজের নাম। হাসি ঠাট্টা, তামাশা, মজা, বিদ্রূপ বা ফেসবুকীয় ভাষায় ট্রল, এবং মিমের ছড়াছড়ি হয় তাকে নিয়ে। উপরন্তু দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্যাটায়ার সাইট পোস্ট করেছে: ‘সারা বছর সমুদ্রের কাছে যান কেউ কিছু মনে করবে না, কিন্তু সমুদ্র একদিন আপনার কাছে আসলে সবাই বন্যা বন্যা বলে চেঁচামেচি করবে, নায়ক রিয়াজের সমালোচনা করবে।’
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার সঙ্গে রিয়াজের নামটি জুড়েগেছে নিশ্চিত ভাবে।
কেন? কেন রিয়াজের নামরে সাথে সাথে এ সময় ইউরোপের কথাও চলে আসে?
ইতিপূর্বে সিঙ্গাপুরের নাম জড়িয়ে ছিল এর সাথে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) প্রাক্তন চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম হলেন সেই ‘সিঙ্গাপুর রহস্যের’ প্রবর্তক।
আবদুচ ছালামের আমলেই দৃশ্যত কিছু উন্নয়ন ঘটে। ফেইসবুক ব্যবহারকারী কিছু সমালোচকের মতে নগরজুড়ে অহেতুক ও অপরিকল্পিত সব উড়ালসড়ক করা হয়েছিল। ঐ সকল উড়ালসড়ক নির্মাণকালে নগরজুড়ে বিভিন্ন স্থানে ব্যানারে লেখা থাকত: চট্টগ্রাম হবে সিঙ্গাপুর। এ কথটির সাথে দেখযেত ছালাম সাহেবের ছবি। তিনি চট্টগ্রামকে সিঙ্গাপুরের মতো গড়ে তোলার বাসনাও প্রকাশ করতেন তার বিভিন্ন বক্তৃতায়।
জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন- হল চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। যার ব্যয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।
এ প্রকল্প হাতে নেয়ার পর যখন থেকে চট্টগ্রাম শহর পানিতে ডুবে যায় এবং উড়ালসড়কের উপরেও পানি জমতে দেখা যায়, পাশাপাশি তার নিচে ঝর্ণার মত পানি পড়তে থাকে, তখন ঐ ‘সিঙ্গাপুর-তত্ত্ব’ নিয়ে মানুষ হাসাহাসি আর ক্ষোভ প্রকাশ। এভাবে মনের ঝাল মেটাতে দেখা যায় মানুষকে।
সেরকমই কোন এক দিনে এক ব্যক্তি একটি বিদ্রূপাত্মক ছড়া লেখেন, যা জনপ্রিয়তা লাভ করে। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার সাথে সাথেই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে সেই ছড়া:
চট্টগ্রাম হবে সিঙ্গাপুর,
পানির নিচে মুরাদপুর।
কে বলেছে চকবাজার?
এটা মোদের কক্সবাজার।
বাসার নিচের সৈকতের পানি,
ভয় নেই মোরা সাঁতার জানি।
অন্যদিকে গত সিটি করপোরেশনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীর নির্বাচনী প্রচারণা থেকে নায়ক রিয়াজের ‘ইউরোপ-তত্ত্বের’ উৎপত্তি।
চট্টগ্রামের গত সিটি নির্বাচনের প্রচারণায় নৌকার পক্ষে জয়গান গাইতে আর নগরবাসীর কাছে ভোট চাইতে ঢাকা থেকে চলচ্চিত্র ও টিভি অঙ্গনের এক দল অভিনেতা-অভিনেত্রী ও নায়ক-নায়িকা গিয়েছিলেন। সে সময় নায়ক রিয়াজ, চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি ও অপু বিশ্বাস, অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাস, বিজরী বরকতুল্লাহ, তানভীন সুইটি ও তারিনসহ অনেকে খোলা ট্রাকে ঘুরে ঘুরে রেজাউলের পক্ষে প্রচার চালায়।
নায়ক রিয়াজ প্রচারণার একপর্যায়ে বলেন, ‘সরকার চিটাংগবাসীর জন্য দুহাত ভরে দিয়েছে, যার প্রমাণ আমরা দেখেছি আসার পথে, চিটাংগের যে রাস্তা দিয়ে আমরা এসেছি, বাংলাদেশের রাস্তা মনে হয়নি, মনে হয়েছে ইউরোপের রাস্তা।’
নব নির্মিত চট্টগ্রাম মেরিন ড্রাইভ রাস্তা হয়ে চিত্রনায়ক রিয়াজ এয়ারপোর্টে নেমে মূল শহরে আসেন। তিনি এমন অনুভূতি প্রকাশ করেছেন নির্বাচনী প্রচারে সেই রাস্তা দেখে। চট্টগ্রামের অন্যান্য রাস্তার পরিস্থিতি প্রতিফলিত হয় না সেই রাস্তা দ্বারা। নির্বাচনী প্রচারণা কালে নগরের অপরাপর রাস্তার অবস্থা ও সড়কের দূরাবস্থা নিশ্চয়ই তিনি দেখেছেন, চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিকেরা মনে করেন, এরপরও তার কাছ থেকে এমন বক্তব্য প্রত্যাশিত ছিল না।
চট্টগ্রামের মানুষ আসলে ফান বা মজা থেকেই রিয়াজকে নিয়ে এসব করে। অনেকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় তাকে গালি দিয়েও মজা নেয়। যদিও ব্যক্তি রিয়াজ নয়। সরকারকে কিছু বলতে পারার ঝাল মিটায় সকলে।
সরকারকে কিছু বলতে পারে না বলেই মানুষ রিয়াজকে নিয়েই ঠাট্টা–বিদ্রূপ করে বলে অনেক নাগরিক মত প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, আসলে হাস্যকর এমন মন্তব্যই রিয়াজকে হাসি-ঠাট্টার পাত্র বানিয়েছে।